।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।।
“বাংলা ভাষার হালচাল”
-রাখী চক্রবর্তী
মা জী দুধ লিজিয়ে,,
–সুবহ্ সুবহ্ মা জী দুধ লিজিয়ে, ঘুমের বারোটা বাজাইয়ে।রূকো যাই,
কি মনে করকে আজ জলদি জলদি আয়া,
—কা হা জলদি মা জী,
–চুপ রহো,কালসে দশ বাজে আনা।ঘুম পুরা নেহি হোতা তো গা ম্যাজ ম্যাজ করতা হ্যায়
–জী মা জী ।জো আপ বোলেঙ্গে
ঘর থেকে লালমোহন বাবু বললেন, ভুতাই তুই রোজ এই সময়েই দুধ দিয়ে যাবি।দশটার সময় এলে আমি চা খাবো কি করে,অফিস যেতে হবে না আমাকে।
সীমা দেবী চিৎকার করে বললেন,
ম্যায় যো বলুঙ্গা ওহি হোগা
ভুতাই দশ বাজে আনা
ভুতাই গোয়ালা জানে এখন কি কি হবে,হাঁ মা জী ঠিিক হ্যায়
বলেই ভুতাই দে ছুট
লালমোহন বাবুর স্ত্রী সীমা দেবীর হিন্দিতে কথা বলা শুরু হয় ভুতাই আসার সময় থেকেই।তারপর সেটা চলে বাজারে ,কাজের মেয়ের সাথে,পাড়া প্রতিবেশি ।লালমোহন বাবু কিছু বলতে গেলেই বাসন পড়ার ঝনঝন শব্দে কাঁপতে থাকে গোটা পাড়া।
সীমা দেবী সকাল ন’টার সময় বাজারে যান, কর্তা অফিস চলে যায় তারপর।বাজারে গিয়ে উনি হিন্দিতে কথা বলেন।ওনার ধারণা হিন্দিতে কথা বললেই মান সম্মান বাড়ে।বাংলা ভাষার কোন দাম নেই ।মাথা নত করতে হয় না হিন্দি ইংরেজি ভাষাতে কথা বললে।এবার জেনে নি উনি আসলে কি ভাষায় কথা বলেন
দোকানদার–আমার থেকে আলু নিয়ে যান ও দিদি, ও বৌদি,নিয়ে যান,,
–আলু কত করে দেতা হ্যায় ?
–পঁচিশ টাকা কিলো।কত দেব?
–টুয়েন্টি ফাইব ! ও ঠিক হ্যায়
দো কিলো দো।পটল কত করে দেতা হ্যায় ?ও ভী দো কিলো দো।
তারপর মাছের বাজারে গিয়ে সীমা দেবী বলেন,
আরে ভাই এ ফিস মরা হ্যায় তো।জিন্দা ফিস দো,লাফালাফি করতা হ্যায় ও ফিস চাই
—ইলিশ মাছ লাফালাফি করে না মা জননী,কৈ মাছ নিন খুব নড়েচড়ে,লাফালাফি করে
–কৈ কত করকে দেতা হ্যায়?
–হাজার টাকা কেজি
–ঠিক হ্যায় দোঠো ওজন করো
বাজারের থলি নিয়ে বাড়ি ফিরে সীমা দেবী বারান্দায় বসে ভাবেন হিন্দি ইংরেজীতে কথা বলে বাজার মাত করে দিয়েছি।
সন্ধ্যা বেলায় কর্তা বাড়ি ফিরলে আবার চলে হিন্দিতে কথাবার্তা ।এর একটা কারণ আছে লালমোহন বাবু সস্ত্রীক উত্তর ভারত যাবেন ঘুরতে ।ছেলে কলকাতায় থাকে ।ফোন করে মাকে বলে দিয়েছে হিন্দিটা ইংরেজিটা একটু চালু রেখো মা,
কাজ দেবে।
ব্যস ,আর থামেন নি উনি হিন্দি, ইংরেজি ,বাংলা ভাষার দফারফা করে ছেড়েছেন ।
সীমা দেবী কলকাতার বাইরে বেড়াতে গেলে সবাইকে বলেন, বিদেশ যাতা হ্যায় হামলোগ ।
লালমোহন বাবু মহা ঝামেলায় পড়েছেন।না হিন্দি না বাংলা আবার ইংরেজি ভাষাও আছে।
–কত বার বলবো।উত্তর ভারত বিদেশ না। ,ভারত নাম শোননি ?
–তোমার বেশি বেশি ।না হয় একটু বিদেশ বললাম।
–ঠিক আছে যা বলার বলো ।উত্তর ভারতে গিয়ে আবার ভাষার প্রদর্শন করো না যেন।
—বলবো ,হিন্দি ইংরেজি ভাষায় কথা বলবো,বাংলা ভাষায় আছে টা কি,
–ঠিক আছে জগা খিচুড়ি ভাষায় কথা বলবে না,পুরো কথা হিন্দি ও ইংরেজিতে বলবে তবেই বুঝবো দম আছে তোমার, বাংলা ভাষাকে অপমান ! কিছুতেই আমি সহ্য করবো না,এই আমি বলে রেখে দিলাম
–ঠিক আছে ঠিক আছে, রেস্টুরেন্টে গিয়ে এগরোল দিন বলো কেন? ময়দায় ডিম প্যাচানো খাবার দিন ,বলতে পারো তো,শুধু আমার বেলায় দোষ,সেদিনকে ফোনে কাকে যেন বললে,রবিবার হলি ডে মর্টন না হলে জমে না,আমি কতবার তোমার কথা শুনে হেসেছি বলো ?
–সেটা অন্য ব্যাপার,ভুল তো কিছু বলছি না
যাইহোক তিন চার দিন পর লালমোহন বাবু সস্ত্রীক উত্তর ভারত ঘুরতে গেলেন,দিল্লিতে লালমোহন বাবুর দিদি থাকেন ,ওখানে থেকেই সব জায়গায় ঘুরবেন।দিল্লিতে পৌছে
ট্রেন থেকে নেমে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছেন ওনারা,
একটা টাটা সুমো আসতে দেখে সীমা দেবী চিৎকার করে উঠলেন
গাড়ি স্টপ গাড়ি স্টপ ,
— গাড়ি থামবে না।তুমি চিল্লে মরো
–কেন থামবে না।আমি কি বাংলা ভাষায় কথা বলছি ?হিন্দি ,ইংরেজি তুমি একাই পারো ?
রণ বাববার বলে দিয়েছে ,মা বাইরে যাচ্ছো হিন্দিতেই কথা বলবে,ছেলেকে তো আর ইনসালট করতে পারিনা
–একদমই না,। ঐ দেখো গাড়ি চলে এসেছে
চলো ,গাড়িতে উঠে বসো
সুমোতে বসলেন সীমা দেবী,বাব্বা বহুত গরমি,
আজি শুনতে হো ড্রাইভার,হ্যালো
জানলা কা কাঁচ নিচে নামা দো,নিশ্বাস নিতে কসট্ হোতা হ্যায়
–“আজি শুনতে হো”,এটা পতিদেবকে সম্মোধন করে বলতে হয়,বুঝলে
ওই দেখো ড্রাইভার ছেলেটা তোমার কথা শুনে হাসছে
–ভুল তো বলি নি।
–না না ভুল কিসের ,বাংলা হিন্দি ইংরেজি ভাষার মিলন করে ছাড়ছো।ফুলশয্যার রাতে যেমন আমাদের মিলন হয়েছিল।মনে আছে কি বলেছিলে ? হা হা ,
আমি গোলাপ ফুল বলতে তোমার কি হাসি
–গোয়ালার সাথে রোজ হিন্দিতে কে কথা বলে তুমি না আমি।ও তো বাংলা বোঝেই না।
হিন্দি আমার রক্তে আছে ।
মুখ দিয়ে তো এক অক্ষর হিন্দি শব্দ বের হয় না।
–আমার পূর্ব পুরুষদের একটা ঐতিহ্য আছে ,
বাংলা ভাষাই আমার কাছে শ্রেষ্ঠ ভাষা ।অহেতুক হিন্দি বলি না।যেখানে প্রয়োজন আছে সেখানে বলতেই হবে,বিমলদা’র ছেলে বিদেশ থেকে ফিরে আমাদের বাড়ি তে আসে তোমার সাথে কি সুন্দর বাংলাতে কথা বলে তোমাকে প্রণাম করে,আর তুমি বলো জি তে রহো বেটা,আরে মন খুলে আশীর্বাদ করতে হয়,তুমি এমন ভান করো যেন বাংলা বলতেই পারো না,
ওনাদের কথোপকথনের মধ্যে
ড্রাইভারের ফোনে রিংটোন বাজবে
“তুমি নির্মল কর মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে” গানটা শুনে লালমোহন বাবু বলেন,
তোমার নাম কি ভাই?
–আমি উদিত প্রসাদ
–শোন ভালো করে উদিত ওর ফোনের রিংটোনে কি সুন্দর গান রেখেছে ।আর তুমি ফোন চালাতেই পারো না।আবার রিংটোন রেখেছো বেবি কো বেস পসন্দ হ্যায় ।
–মুহু বনদ্ করো,প্রেসটিজ হ্যায় মেরা
—সে তো ভালোই জানি,বাংলাতে কথা বলো,লোকে সন্মান করবে।কখনও শুনেছো কোনও ইংরেজকে কথা বলার সময় মাঝে মাঝে কোন বাংলায় কিছু বলতে ।হিন্দি ভাষী যারা তারাও কিন্তু তাদের ভাষার মধ্যে বাংলা ভাষাকে আনে না।কিন্তু আমরা বাঙালি হয়ে বাংলা ভাষার অপমান করছি।বাংলার মধ্যে হিন্দি ইংরেজি ভাষাকে টেনে আনছি।কেন ? এ প্রশ্ন শুধু আমার না।
–স্টপ ।অনেক হয়েছে ,রোজ সকালে কে বলে গুড মর্নিং ।এক কাপ চা দাও ।পেয়ালা কি তুমি বলো ?আসলে কথা বলার সময় আমাদের খেয়াল থাকে না তাই বাংলা হিন্দি ইংরেজি ভাষা মিলিয়ে মিশিয়ে কথা বলি।তার মানে এটা না যে বাংলা ভাষাকে অপমান করছি
–সব মানলাম ।কিন্তু তুমি জগাখিচুড়ি ভাষায় কথা বলবে না।
বাংলাতে কথা বললে হিন্দি বলবে না।করেগা ,খায়েগা ,দেগা অসহ্য লাগে ।
মনে রেখো ,”বাংলা ভাষা গর্বের ভাষা ,নয়তো অবহেলার।
এই ভাষাতেই “ভারত ছাড়ো” হুঙ্কারে বৃটিশরা হয়ে ছিল জেরবার “
–দাদা আপনারা এখানেই নামবেন তো?।আপনার কথা শুনে খুব ভালো লাগলো দাদা।বাংলা ভাষা গর্বের ভাষা নয়তো অবহেলার।যথার্থ বলেছেন দাদা।
–থ্যাঙ্ক ইউ ভাই
লালমোহন বাবুর ইংরেজি মেশানো বাংলা কথা শুনে
সীমা দেবীর চোখ দিয়ে আগুন ঠিকরে বের হচ্ছে । চোখ দিয়ে মা চন্ডীর রুদ্র রুপ বেরিয়ে পড়েছে ।
লালমোহন বাবু মনে মনে ভাবছেন সব জ্ঞান মাটিতে মারা গেল।ধ্যাত তেরি,,কি দরকার ছিল থ্যাঙ্ক ইউ বলার ।অশেষ ধন্যবাদ ভাই বললে কি হতো।ঠিকই তো কথা বলার সময় খেয়ালই থাকে না কি বলছি।নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে লালমোহন বাবু হেসে বললেন,
তুমি ঠিক বলেছো গো, কথা বলার সময় অনেকেরই খেয়াল থাকে না
উদিত গাড়িটা থামিয়ে বলল, বৌদি খুব সুন্দর কথা বলেন ।বৌদির কথা শুনে একটু হাসলাম।এটাই বা কম কিসের । মানুষের দুঃখ কষ্ট ভুলিয়ে দেয় কিছু কিছু কথা।সে বাংলা ভাষায় হোক বা জগাখিচুড়ি ভাষায় ।আমি তো খুব হাসলাম,আপনাদের মনে রাখতেই হবে, দাদা
আমি আপনাদের ব্যাগগুলো নামিয়ে দিচ্ছি
সীমা দেবী বললেন, অল রাইট।ঠিক আছে
লালমোহন বাবু হেসে বললেন ,এই তো আগে ইংরেজি বলে তারপর না হয় বাংলায় বলে দিও।কোনও সমস্যা নেই।
–লেটস গো।চলো
লালমোহন বাবু স্ত্রীর হাত ধরে গাড়ি থেকে নামিয়ে ওনার কানে কানে বললেন ,আমি তোমাকে ভালবাসি,আই লাভ ইউ।
সীমা দেবী মুচকি হেসে বললেন আই লাভ ইউ টু,তিন চার পাঁচ ছয় সাত,,,,
উদিত হাসতে হাসতে গাড়ি চালাতে শুরু করলো, সূর্যটাও অস্ত যাওয়ার আগে শেষ হাসিটা হাসলো।